ওরা বাচ্চা ছেলে না, ওরা রাস্তার ছেলে

রাত বাজে প্রায় সাড়ে নয়টা। ইউনিভার্সিটি’র একটা প্রোগ্রাম ছিলো। ছোটদের আমন্ত্রন আর বড়দের বিদায় প্রোগ্রাম। প্রোগ্রাম প্রায় শেষের পথে। আমি আর আমার বন্ধুরা বের হয়ে এসেছি। চায়ের দোকানের পাশে বসে আড্ডা দিচ্ছি। প্রোগ্রামে আমাদেরকে একটি করে খাবারের প্যাকেট দিয়েছে। আইটেম গুলো হচ্ছে আপেল, সন্দেশ, স্যান্ডউইচ আর একটা কোল্ড-ড্রিঙ্কস। যে যারটা খেয়ে ফেলেছে। দুই একজন রেখে দিয়েছে বাড়ি গিয়ে আয়েশ করে খাবে। রাস্তার ওপাশে হোটেলের আলো এসে আমাদের এদিকে পড়েছে। আমি আমার প্যাকেট খুলতে যাবো দেখি দুইটা বাচ্চা ছেলে আমাদের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। বাচ্চা ছেলে ঠিক না, ওরা হচ্ছে রাস্তার ছেলে। দুইজনেরই আট দশ বছরের বেশি বয়স হবেনা। আমার দুই একজন বন্ধু দাড়িয়ে দাড়িয়ে খাচ্ছিলো। দেখলাম ছেলে দুটো রাজ্যের আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। ওরা আসলে কোল্ড-ড্রিঙ্কস এর বোতল গুলো নিতে এসেছে। এক একজন খাওয়া শেষে বোতল গুলো ফেলে দিচ্ছে আর ওরা টুপ করে বোতলগুলো নিয়ে গায়েব করে ফেলছে। গায়েব করেই আবার হাঁ করে আমাদের খাওয়া দেখছে। আর আমি তাকিয়ে আছি ওদের দিকে। বুকের ভিতরটা জানি কেমন করে উঠলো। হটাৎ এক বন্ধু বিরক্ত নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, “কি চাস?” ওরা বলল, “কিছুনা, বোতলগুলো নিতি আইছি।” বন্ধু তার হাতের বোতল শেষ করে ওদের দিয়ে বলল, “এই নে, যা ভাগ।” ওরা নিয়েই দৌড় দিলো। আবার কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে হাজির হলো। আমি ততক্ষণে প্যাকেট থেকে স্যান্ডউইচ বের করে খাওয়া শুরু করছি। খাওয়ার অর্ধেক পথে দেখি ওরা আমার মুখের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি ইশারা দিয়ে বললাম, “কি?” ওরা বলল, “বোতল।” আর তখনি আমার সেই বন্ধু ওদের তাড়া দিয়ে বলল, “ওই, তোদের না যাইতে বললাম এখান থেকে? ভাগ। নাইলে মেরে ঠ্যাং লুলা করে ফেলবো।”

ওরা নির্বিকার। এধরনের গালি ওরা সারাদিন এখানে সেখানে খায়। ভাত না জুটলেও গালি ওদের প্রতিদিন জোটে। ওরা কিছু না বলে আমার দিকে তাকিয়েই রইলো। কখন আমি কোল্ড- ড্রিঙ্কস শেষ করে বোতলটা ওদের হাতে দেবো সেই জন্য। আমি স্যান্ডউইচ শেষ করে হাত ঝেড়ে আপেলটা হাতে নিলাম। ওদের একজনকে হাত নেড়ে ডাক দিলাম, “তুমি এইদিকে আসো।” সে এগিয়ে আসলে ওর হাতে আপেলটা দিলাম। যখন আপেলটা দিতে গেলাম দেখি দ্বিতীয়জনও হাত বাড়িয়েছি আপেলটা নেওয়ার জন্য। তারপর দ্বিতীয়জনের হাতে সন্দেশটা দিলাম। ওরা দুইজনেই সাথে সাথে মুখ ভরে হাঁসি দিলো। খুশিতে ওরা কি করবে এমন অবস্থা। ওরা বুঝতেই পারিনি। আমি প্যাকেটের বাকি সব খাবার ওদের দিয়ে দেবো। জিজ্ঞাসা করলাম, “খুশি?” ওরা মাথা নেড়ে সায় দিলো যে হ্যাঁ ওরা অনেক খুশি। বললাম, “ভাগ করে খাবা। ঠিকাছে? আর এখানে দাঁড়ায় খাও।” ওরা খাওয়া শুরু করলো। আর আমিও কোল- ড্রিঙ্কসটা খুলে খেতে শুরু করলাম। যখন ওদের খাওয়া শেষ তখন আমার কোল- ড্রিঙ্কসের বোতলের অর্ধেক শেষ হয়েছে। বোতলটা ওদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “খাও।” ওরা বোতলটা হাতে নিয়ে দুইজনেই সমান করে বাকিটা খেয়ে ফেললো। খাওয়া শেষে হাঁসি দিয়ে বোতল নিয়ে চলে গেলো।

আমি প্রায় ভাবি, হয়তো এদের বাবা মা নেই। হয়তো বাবা মা আছে কিন্তু ওদের দেখে না। প্রতিদিন ওরা মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে বাঁচে। আর আমাদের মত সুশীল সমাজ, শিক্ষিত সমাজের দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। আমাদের শিক্ষিত সমাজের বাচ্চারা স্কুলে যায় আর ওরা ওদের দিকে অসহায়ের মত চেয়ে থাকে। হয়তো কোনোদিন দুবেলাও খাবার জোটেনা। বিভিন্ন হোটেলের সামনে দাড়িয়ে মানুষের খাওয়া চেয়ে চেয়ে দেখে। দুইটা টাকার জন্য আমাদের কাছে এসে কি বাহানাই না করে। বেশির ভাগ সময় তো আমরা ওদের দিয়ে তাকাইও না পর্যন্ত। আমি নিজেই এমন করি। কোনো বাচ্চা ছেলে বা মেয়ে এসে টাকা চাইলে অন্যদিকে তাকিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে ঠাণ্ডা গলায় বলি, “হবেনা।” জন্মই ছিলো ওদের জন্য সব থেকে বড় পাপ। লেখকরা ওদের নিয়ে বই লেখেন বড় বড় বুলি আওড়ান। আর সুশীল সমাজের মানুষ ওদের গালি দেয়। ওরা জোচ্চোর, ঠগ, মিথ্যাবাদী, বদমাশ। ওরা বাচ্চা ছেলে না, ওরা রাস্তার ছেলে। ওদের কোনো যোগ্যতা নেই, কোনো অধিকার নেই আমদের পাশে থেকে বড় হবার। ওদের স্থান আমদের বইয়ে, চিত্রশিল্পে, সিনেমাতে, মুখে। আর কোথাও ওদের স্থান নেই। কোথাও না।

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

Kabhi Haan Kabhi Naa

চিঠি

Memories of Murder (2003)