ওসমান গনি

“কোনো মানুষ যখন একই কাজ দুইবার করে তখন তাকে কি বলা হয়?”
আমি বললাম, “পাগল।”
জাহিদুর রহমান বললেন, “হ্যাঁ, তবে সুস্থ মানুষও কিন্তু একই কাজ দুইবার করে। যেটা সে সবসময় বুঝতে পারেনা।”
“ঠিক বুঝলাম না। বুঝিয়ে বলেন।”
“বলছি, তার আগে বলুন চা খাবেন তো? আমি আর কিছু বানাতে পারি আর না পারি চা’টা ভালো বানাতে পারি, সে কথা জানেন নিশ্চয়ই?”
আমি হেসে দিয়ে বললাম, “সে কথা আর বলতে? আমি আপনার কাছে আসিই তো আপনার হাতের এক কাপ চা খাওয়ার লোভে। কতদিন আসা হয়না এদিকে।”
“ওকে। আপনি বসুন। আমি মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আসছি।”

জাহিদুর রহমান একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। এখন অবসরে আছেন। অবসর বলতে তিনি ইচ্ছা করেই অধ্যাপনা ছেঁড়ে দিয়েছেন। এখন সারাদিন বাসায় পরে থাকেন আর পড়াশুনা করেন। ভদ্রলোক বিবাহ করেননি। খুবই সাধারন একটা মানুষ। কারো সাতেও থাকেন না, পাঁচেও থাকেন না।

জাহিদুর রহমান চা নিয়ে চলে এলেন। আমি চা এর কাপ হাতে নিতে নিতে বললাম, “হ্যাঁ, এবার আমাকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলুন।”

“ধরুন আপনি রিক্সা করে কোথাও যাচ্ছেন। হটাৎ আপনার কেন জানি মনে হলো যে আপনি রিক্সা থেকে পড়ে যাবেন। কিন্তু পড়েননি। দু’মাস পড়ে দেখা গেলো, ঠিক সেই জায়গা দিয়েই আপনি রিক্সা করে যাচ্ছেন এবং আপনার মনে হচ্ছে আপনি পড়ে যাবেন, এবং পড়ে যাবার অনুভূতিটা একদম ঠিক সেদিনের মতই। আরেকটা উদাহরণ দেই, ধরুন প্রতিদিন সন্ধায় আপনি চা খান। প্রতিবার প্রতি চুমুকে কিন্তু আপনার মুখে একই পরিমান চা যায়না। একেকবার একেক পরিমান চা যায়। তো একদিন আপনার চা খেতে গিয়ে মনে হলো, আপনি ঠিক একই ভাবে, একই কায়দায়, একই পরিমান চা এর আগেও খেয়েছেন। মনে হবার কোনো কারন নেই। তবুও আপনার মনে হবে। এই কাজটা করবে আপনার Unconscious mind.”
“হুম। বুঝলাম।”
“ওসমান গনির গল্প শুনবেন?”
“ওসমান গনি কে?”

বলছি। গল্পটা শুরু থেকে বলি। ওসমান গনি নামে একটা লোক আমার কাছে প্রতিসন্ধায় আসতো। একই কাজ দুইবার করার মত সে সচেতন ভাবেই প্রতিসন্ধায় ঠিক ৭ টার সময় আমার ঘরের দরজায় এসে কড়া নাড়ত। প্রথম যেদিন এলো, সেদিন দরজা খোলার পর ভদ্রলোক আমাকে সালাম দিয়েছিলো। আমি উত্তর দেওয়ার পরে সে একটা হাসি দিয়ে চলে গেলো। আমি তাকে ডাকতে গিয়েও ডাকিনি। এরপর দিন থেকে শুরু হল অত্যাচার। প্রতিসন্ধায় সে নিয়ম করে ঠিক সন্ধ্যা ৭টায় আমার কাছে আসবেই। শুরুতে শুধু সে সালামই দিত। আর কোনো কথা বলতো না। আমি কিছু জিজ্ঞাসা করলে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে থাকতো। মিনিট পাঁচ সাতের বেশি সময় সে থাকতো না। এর কিছুদিন পর সে শুধু সালামই দিতো না, সালামের উত্তর করার পর সে নিজে থেকেই নানান কথা বলতো। বেশির ভাগ কথার কোনো অর্থ আমি খুজে পেতাম না। একদিন সে বলল, “ভাইজান, চা দিয়ে কখনো কলা খেয়েছেন? অদ্ভুত লাগে। এক কাপ গরম চায়ের মধ্যে কলা চুবিয়ে চুবিয়ে খাবেন। যদি মজা না পান তাহলে বালি খাই।” আরেকদিন বলল, “ভাইজান, শীতের রাতে নগ্ন হয়ে পুকুরের ঠাণ্ডা পানিতে নেমে গাজা খেয়ে দেখছেন? প্রচুর নেশা হয়। তাল ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।”

আমি এইসব অর্থহীন কথার কখনো গুরুত্ব দিতাম না। ভদ্রলোক ছিল সরকারি চাকুরীজীবী। লম্বা এবং স্বাস্থ্যবান। চেহারায় নূরানি ভাব প্রবল ছিলো। যতবার আমার সাথে তার দেখা হয়েছে, তাকে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি পরতে দেখেছি। মাথায় সব সময় টুপি পরত। এমন একজন মানুষ এধরনের উদ্ভট কথা কেন বলবে বুঝে উঠতে পারিনি। তবে একবার সে এসে বলল, “আপনার বাড়ির সামনের বাড়িতে আজ রাতে একটা হত্যাকাণ্ড হবে। সাবধানে থাকবেন।” আমি শুনেই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। পরেরদিন সকালে শুনি, সামনের বাড়ির মালিক হাসনত হোসেন নাকি খুন হয়েছেন। সেদিন সন্ধায় ওসমান সাহেব আসলে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি, সে এটা কিভাবে টের পেলো? সে কোনো উত্তর করেনি।

আমি তাকে তার নিজের সম্পর্কে অনেক কিছুই জিজ্ঞাসা করেছি। সে শুধু বলেছে, “তার কোনো পরিবার নেই।” আর কিছুই সে আমাকে বলেনি। আমিও তার সম্পর্কে এর থেকে বেশি কিছু জানতাম না। হটাৎ একদিন দেখলাম তার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। তাকে আর আগের মত হাসিখুশি দেখতাম না। সে মনমরা হয়ে থাকতো। এসে শুধু সালামটা দিয়ে চলে যেতো। একদিন আমার একটু কাজ ছিল, তো বাসায় এসেছি দেরি করে। তখন রাত বাজে প্রায় ৯টা। বাসায় এসে দেখি, দরজার সামনে একটা কাগজ রাখা। কাগজটায় লেখা ছিল, “আমার যাবার সময় হয়ে এসেছে। আমি চলে যাচ্ছি। আর দেখা হবে না। আপনি ভালো থাকবেন।” তার লেখা দেখে একটা বিষয় শুধু বুঝেছি যে লেখাটা বাম হাতের। সে চিঠিটা বাম হাত দিয়ে লিখেছে।

এরপর ওসমান গনি আর আসেনি। প্রায় একমাস পড়ে মনে হলো, ভদ্রলোকের খোঁজ নেওয়া দরকার। চলে গেলাম তার অফিসে। তিনি ইনকাম ট্যাক্স অফিসে চাকরি করতেন। ওখানে ওরা বলল, ওসমান গনি নামে তাদের অফিসে কেউ চাকরি করেনা। আমি পরলাম অথৈ সমুদ্রে। কারন এই একটা তথ্য ছাড়া আমার কাছে আর কোনো তথ্য নেই। তবুও আমি হাল ছাড়লাম না। তন্ন তন্ন করে তাকে খুজতে লাগলাম। পেপারে বিজ্ঞাপন দিলাম। মিডিয়ায় লোক ছিল তাদের জানালাম। নিজে এদিক সেদিক খোঁজ লাগালাম। সে কোথাও নেই। একদিন আমি নিশ্চিত হলাম যে, ওসমান গনি নামের ওই ভদ্রলোকের আসলেই কোনো অস্তিত্বই ছিল না। পুরোটাই আমার মনের ভুল। কিভাবে বুঝলাম জানেন?

“কিভাবে?”

আমি থাকি তিনতলা একটা বাসায়। দোতলায় যারা থাকেন সচারচর তারা কখনো দরজা বন্ধ করেন না। দোতলা যে ভদ্রলোক থাকেন তিনি একদিন আমাকে এসে বললেন, “আপনি দাবি করছেন যে আপনার কাছে প্রতি সন্ধায় ৭টার সময় ওসমান গনি নামে এক ভদ্রলোক আসতেন, তাকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি বলছি, ওই সময় আমাদের এই বাড়ির মধ্যে কেউ আসতো না। কারন, আমি সন্ধার সময় দরজা খুলে রেখে, দরজার পাশে বসে কোরান শরীফ পড়ি। কেউ সিঁড়ি দিয়ে উঠলে আমি অবশ্যই দেখবো।”

“বলেন কি? তাহলে ওই চিঠি আর হত্যাকাণ্ডের ব্যাপার টা?”

ব্যাখ্যা আছে। ব্যাখ্যাটা হল, আমার দরজার পাশে ছাদের দরজা, ছাদ থেকে অনেক কাগজ বাতাসে উড়ে আসতে পারে। হয়েছে তাই। অন্য কারো কাগজ আমার দরজার সামনে উড়ে এসেছে।

“আর হত্যাকাণ্ড?”

প্রতিদিন ওই বাড়িতে চিল্লাপাল্লা হতো, ঝগড়া হতো। আমি তাদের কিছু কথা শুনতেও পেতাম। তাদের ঝগড়ার মধ্যে কেউ একজন প্রায়ই একটা কথা বলতো, “আমি তোকে খুন করে ফেলবো।” সুযোগ বুঝে আমার অবচেতন মন, বিষয়টা কাজে লাগিয়েছে।

ইশতিয়াক সাহেব, তারপরেও আমার মনের মধ্যে খটকা রয়ে গেছে। খটকা দূর করার জন্য আমি লন্ডনের একটি ল্যাবরেটরিতে চিঠিটা পাঠিয়েছিলাম পরীক্ষা করার জন্য। তারা জানিয়েছে, চিঠির কাগজ এবং কালি কোনটার origin এই গ্রহের না। অন্য কোনো গ্রহের।

“বলেন কি? চিঠিটা কি দেখানো যায়?”

“হ্যাঁ।” জাহিদুর রহমান ড্রয়ার থেকে চিঠিটা বের করে আমার হাতে দিলেন। আমি দেখলাম। আমার মনে হলো, অদ্ভুত এক রহস্য হাতে নিয়ে বসে আছি। যার জন্ম এই গ্রহে না। অন্য কোনো অজানা এক গ্রহে।

Comments

Popular posts from this blog

Kabhi Haan Kabhi Naa

চিঠি

Awe! (2018)