পুতুল
আমি মোটামুটি নিশ্চিত আমার সাথে কেউ হাঁটছে এবং মানুষটা যখন থেকে আমার
সাথে হাঁটছে তখন থেকেই আমি অন্য রাস্তায় হাঁটছি। তবে মানুষটা যে মানুষ না
সে ব্যাপারেও আমি মোটামুটি নিশ্চিত। অন্য রাস্তায় হাঁটছি সেটা বুঝতে পারছি
কারন আমি রাস্তা চিনতে পারছি না। আমার পা কাঁপছে। রাত এতক্ষণে প্রায় দুইটা
বাজার কথা। শীত পুরোপুরি পড়েনি। হালকা ঠাণ্ডা বাতাসে শরীর জমে যাচ্ছে। মনে
হচ্ছে পাঞ্জাবি ভিজে গেছে। আমি কোনদিকে হাঁটছি কেনই বা হাঁটছি বুঝতে পারছি
না। ইচ্ছা করছে সাথের মানুষটাকে জিজ্ঞাসা করি, “ভাই? আমরা কোথায় যাচ্ছি?
আপনার কাছে সিগারেট হবে? খুব ভয় করছে। সিগারেট টানলে ভয় কিছুটা কমার কথা।”
জিজ্ঞাসা করা সম্ভব না। কারন এখন মনে হচ্ছে, পা বাদে সমস্ত শরীর জমে গেছে। শীতে কিংবা ভয়ে। আট বছর পরে গ্রামে এসেছি। সেটা সমস্যা না। সমস্যা হচ্ছে এত রাতে বের হওয়া উচিত হয়নি। বিশ্বাস করা উচিত ছিল যে গ্রামে গঞ্জে এখনো ভুত আছে। ভুত? আচ্ছা মানুষটা কি আসলে ভুত? নাকি অশরীরী প্রেতাত্মা? নাকি অন্য কিছু? পরিবেশটা ঘোর লাগানো। আশেপাশে গাছপালা। কোথাও মাঠ। কোথাও পুকুর। মাঝে ভাঙ্গা রাস্তা। এমন ঘোর লাগা পরিবেশে বাতাসের শো শো শব্দে এমনিতেই ভয় লাগার কথা। সেখানে আমার সাথে আছে "অন্য কিছু" যার সংজ্ঞা জানিনা। এখনো যে হেঁটে চলেছি, সেটাই বিশাল ব্যাপার।
কোথাও কেউ কাঁদছে। খুব সম্ভবত বাচ্চা কোনো মেয়ে। নাকি এটা আমার বিভ্রম? ঘোরের মধ্যে আছি বলে এমন মনে হচ্ছে? কিংবা এটা “অন্য কিছু”র কর্মকান্ড! নাহ, আমি স্পষ্ট কারো কান্না শুনছি। আমি দাড়িয়ে গেলাম। এগিয়ে গেলাম ভেসে আসা শব্দের দিকে। যে দিকে এগিয়ে গেলাম সেটা আরও বেশি ছিমছাম, আরও বেশী ভয়ঙ্কর একটা জায়গা। ভালোভাবে বুঝতে পারলাম, এটা একটা কবরস্থান এবং এমন অস্পষ্ট পরিবেশে স্পষ্টভাবে যা দেখলাম তাতে আমার ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবার কথা। একটা মেয়ে কবরের কাছে বসে মাথা নিচু করে কাঁদছে। আমি তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালে সে আমার দিকে তাকাল। আমি নিজেকে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রন রেখে খুব স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞাসা করলাম, “এই মেয়ে, তুমি কে? এত রাতে এখানে কি করছ?” মেয়েটি বলল, “আমাকে বাঁচাও, আমি বের হতে পারছি না।”
- তুমি কোথা থেকে বের হতে পারছো না?
এখান থেকে।
- এই কবর থেকে?
হ্যাঁ?
- চলো আমি তোমাকে নিয়ে যাই। আসো আমার হাত ধরো।
আমি তো যেতে পারবো না।
- কেন?
আমি তো ভিতরে। আমি যাবো কিভাবে? আমাকে বের করো।
- তুমি কি কবরের ভিতরে?
হ্যাঁ।
সাথে সাথে আমার ভয় উচ্চ পর্যায়ে চড়ে গেলো। আমি কোনোমতে পা শক্ত করে দাড়িয়ে আছি। ঠিক তখনি, আমার সাথে যে ছিল সে আমার পিঠে হাত কিংবা কিছু একটা রেখে হালকা করে ধাক্কা দিলো। বুঝতে পারলাম, কবরটা খুড়তেই হবে। আমি যুক্তিযুক্ত ভাবে কিছুই ভাবতে পারছি না। সেটা সম্ভবও না। আমি হাঁটু গেঁড়ে মেয়েটার পাশে বসে পড়লাম। জিজ্ঞাসা করলাম, “তোমার নাম কি?” মেয়েটা অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকল। আবার জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি কি মারা গেছো?” মেয়েটা আরও অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকল। কিছুক্ষণ কবর খুঁড়ে আবার জিজ্ঞাসা করলাম, “তোমার বাবা মা কোথায়?” মেয়েটি এবার উত্তর দিলো, “বাবা কই জানিনা। মা আমার সাথেই আছে।” মেয়েটার উত্তর শুনে আমার শরীরের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। “বলে কি এই মেয়ে? এক কবরে দুই লাশ?” আর কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস পেলাম না। কবর খোঁড়ায় মন দিলাম। খুঁড়তে খুঁড়তে নেশার মত হয়ে গেলো। কোদাল থাকলে ভালো হতো। হাত দিয়ে কতক্ষণ?
কত সময় গেছে জানিনা। কবর খোঁড়া প্রায় শেষ। বাশের ফাক দিয়ে দেখলাম কি যেন নড়ে উঠলো। বাশ গুলো সরিয়ে কবরের ভিতরে যা দেখলাম, তার জন্য আমি কোনো ভাবেই প্রস্তুত ছিলাম না। হতভম্ব হয়ে দেখলাম, যে মেয়েটা আমার পাশে এতক্ষণ বসে ছিল, সে কবরের ভিতরে বসে আছে। আর আমার পাশে যে মেয়েটা বসে ছিল, সে সেখানে নেই। মেয়েটা বসে আছে লাশের পায়ের কাছে। লাশটা সম্ভবত তার মায়ের। আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম মেয়েটির দিকে। মেয়েটি আমার হাত ধরল। ঠাণ্ডা হাত। শক্ত হয়ে আছে। টেনে তুললাম তাকে। মেয়েটা তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি মেয়েটাকে এক পাশে বসিয়ে দিয়ে আবার বাঁশ গুলো জায়গা মত রেখে কবরে মাটি দিয়ে দিলাম। একটা সিগারেট আসলেই দরকার। আমি অভ্যাসমত পকেটে হাত দিলাম জেনেও যে সেখানে কিছু নেই। কিছু পেলামও না। পিছন ফিরে তাকালাম। মেয়েটি নেই। তবে সেখানে একটা পুতুল রাখা। এই পুতুলটা সে এতক্ষণ কোলের মধ্যে জড়িয়ে রেখেছিল। চারিদিকে ভালো করে একবার তাকালাম। খুঁজলাম। কেউ নেই। সেই ভয়টাও নেই।
কাছেই একটা বেশ বড় পুকুর। আমি পুকুর পাড়ে গিয়ে বসলাম। আমার পাশে পুতুলটা। ভোর হয়ে গেছে। চারিদিকে হালকা কুয়াশা। তবে সব কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অভ্যাসমত পকেটে আবার হাত দিলাম। সারা রাত যে ভয়ে ছিলাম, তার থেকে বেশীই ভয় পেলাম। সারা রাতের ভয়ের কাছে এই ভয় কিছুই না। আমার পকেটে একটা ম্যাচ বক্স আর একটা সিগারেট। ইতইস্ত করে সিগারেটটা ধরলাম। প্রথম টানটা দিয়ে পুতুলটার দিকে তাকালাম। বললাম, “তোর নাম তাহলে পুতুল? তোর সাথে কি আর দেখা হবে? সেদিনও কি এভাবে ভয় দিবি?”
জিজ্ঞাসা করা সম্ভব না। কারন এখন মনে হচ্ছে, পা বাদে সমস্ত শরীর জমে গেছে। শীতে কিংবা ভয়ে। আট বছর পরে গ্রামে এসেছি। সেটা সমস্যা না। সমস্যা হচ্ছে এত রাতে বের হওয়া উচিত হয়নি। বিশ্বাস করা উচিত ছিল যে গ্রামে গঞ্জে এখনো ভুত আছে। ভুত? আচ্ছা মানুষটা কি আসলে ভুত? নাকি অশরীরী প্রেতাত্মা? নাকি অন্য কিছু? পরিবেশটা ঘোর লাগানো। আশেপাশে গাছপালা। কোথাও মাঠ। কোথাও পুকুর। মাঝে ভাঙ্গা রাস্তা। এমন ঘোর লাগা পরিবেশে বাতাসের শো শো শব্দে এমনিতেই ভয় লাগার কথা। সেখানে আমার সাথে আছে "অন্য কিছু" যার সংজ্ঞা জানিনা। এখনো যে হেঁটে চলেছি, সেটাই বিশাল ব্যাপার।
কোথাও কেউ কাঁদছে। খুব সম্ভবত বাচ্চা কোনো মেয়ে। নাকি এটা আমার বিভ্রম? ঘোরের মধ্যে আছি বলে এমন মনে হচ্ছে? কিংবা এটা “অন্য কিছু”র কর্মকান্ড! নাহ, আমি স্পষ্ট কারো কান্না শুনছি। আমি দাড়িয়ে গেলাম। এগিয়ে গেলাম ভেসে আসা শব্দের দিকে। যে দিকে এগিয়ে গেলাম সেটা আরও বেশি ছিমছাম, আরও বেশী ভয়ঙ্কর একটা জায়গা। ভালোভাবে বুঝতে পারলাম, এটা একটা কবরস্থান এবং এমন অস্পষ্ট পরিবেশে স্পষ্টভাবে যা দেখলাম তাতে আমার ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবার কথা। একটা মেয়ে কবরের কাছে বসে মাথা নিচু করে কাঁদছে। আমি তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালে সে আমার দিকে তাকাল। আমি নিজেকে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রন রেখে খুব স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞাসা করলাম, “এই মেয়ে, তুমি কে? এত রাতে এখানে কি করছ?” মেয়েটি বলল, “আমাকে বাঁচাও, আমি বের হতে পারছি না।”
- তুমি কোথা থেকে বের হতে পারছো না?
এখান থেকে।
- এই কবর থেকে?
হ্যাঁ?
- চলো আমি তোমাকে নিয়ে যাই। আসো আমার হাত ধরো।
আমি তো যেতে পারবো না।
- কেন?
আমি তো ভিতরে। আমি যাবো কিভাবে? আমাকে বের করো।
- তুমি কি কবরের ভিতরে?
হ্যাঁ।
সাথে সাথে আমার ভয় উচ্চ পর্যায়ে চড়ে গেলো। আমি কোনোমতে পা শক্ত করে দাড়িয়ে আছি। ঠিক তখনি, আমার সাথে যে ছিল সে আমার পিঠে হাত কিংবা কিছু একটা রেখে হালকা করে ধাক্কা দিলো। বুঝতে পারলাম, কবরটা খুড়তেই হবে। আমি যুক্তিযুক্ত ভাবে কিছুই ভাবতে পারছি না। সেটা সম্ভবও না। আমি হাঁটু গেঁড়ে মেয়েটার পাশে বসে পড়লাম। জিজ্ঞাসা করলাম, “তোমার নাম কি?” মেয়েটা অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকল। আবার জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি কি মারা গেছো?” মেয়েটা আরও অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকল। কিছুক্ষণ কবর খুঁড়ে আবার জিজ্ঞাসা করলাম, “তোমার বাবা মা কোথায়?” মেয়েটি এবার উত্তর দিলো, “বাবা কই জানিনা। মা আমার সাথেই আছে।” মেয়েটার উত্তর শুনে আমার শরীরের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। “বলে কি এই মেয়ে? এক কবরে দুই লাশ?” আর কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস পেলাম না। কবর খোঁড়ায় মন দিলাম। খুঁড়তে খুঁড়তে নেশার মত হয়ে গেলো। কোদাল থাকলে ভালো হতো। হাত দিয়ে কতক্ষণ?
কত সময় গেছে জানিনা। কবর খোঁড়া প্রায় শেষ। বাশের ফাক দিয়ে দেখলাম কি যেন নড়ে উঠলো। বাশ গুলো সরিয়ে কবরের ভিতরে যা দেখলাম, তার জন্য আমি কোনো ভাবেই প্রস্তুত ছিলাম না। হতভম্ব হয়ে দেখলাম, যে মেয়েটা আমার পাশে এতক্ষণ বসে ছিল, সে কবরের ভিতরে বসে আছে। আর আমার পাশে যে মেয়েটা বসে ছিল, সে সেখানে নেই। মেয়েটা বসে আছে লাশের পায়ের কাছে। লাশটা সম্ভবত তার মায়ের। আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম মেয়েটির দিকে। মেয়েটি আমার হাত ধরল। ঠাণ্ডা হাত। শক্ত হয়ে আছে। টেনে তুললাম তাকে। মেয়েটা তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি মেয়েটাকে এক পাশে বসিয়ে দিয়ে আবার বাঁশ গুলো জায়গা মত রেখে কবরে মাটি দিয়ে দিলাম। একটা সিগারেট আসলেই দরকার। আমি অভ্যাসমত পকেটে হাত দিলাম জেনেও যে সেখানে কিছু নেই। কিছু পেলামও না। পিছন ফিরে তাকালাম। মেয়েটি নেই। তবে সেখানে একটা পুতুল রাখা। এই পুতুলটা সে এতক্ষণ কোলের মধ্যে জড়িয়ে রেখেছিল। চারিদিকে ভালো করে একবার তাকালাম। খুঁজলাম। কেউ নেই। সেই ভয়টাও নেই।
কাছেই একটা বেশ বড় পুকুর। আমি পুকুর পাড়ে গিয়ে বসলাম। আমার পাশে পুতুলটা। ভোর হয়ে গেছে। চারিদিকে হালকা কুয়াশা। তবে সব কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অভ্যাসমত পকেটে আবার হাত দিলাম। সারা রাত যে ভয়ে ছিলাম, তার থেকে বেশীই ভয় পেলাম। সারা রাতের ভয়ের কাছে এই ভয় কিছুই না। আমার পকেটে একটা ম্যাচ বক্স আর একটা সিগারেট। ইতইস্ত করে সিগারেটটা ধরলাম। প্রথম টানটা দিয়ে পুতুলটার দিকে তাকালাম। বললাম, “তোর নাম তাহলে পুতুল? তোর সাথে কি আর দেখা হবে? সেদিনও কি এভাবে ভয় দিবি?”
Comments
Post a Comment