ভুল

নাবিলা স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে চাঁদের দিকে। সে বসে আছে ছাদের দেয়ালে হেলান দিয়ে। নীল রঙের শাড়িতে তাকে দেখাচ্ছে ইন্দ্রাণীর মতো। অসম্ভব মায়াকড়া দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে চাঁদের দিকে। চাঁদের সমস্ত আলো এসে পড়েছে তার মুখে। যেন এই আলো হাজার বছর ধরে অপেক্ষা করেছিল তাকে আলোকিত করার জন্য। কাছেই বসে আছে জামিল হোসেন। তার হাতে সিগারেট। মাত্র ধরিয়েছে। সে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে অবাক হয়ে নাবিলার দিকে তাকিয়ে আছে। তার অবাক হবার প্রধান কারন হচ্ছে, একটা মৃত মানুষকে শুধু চাঁদের আলোতে এতোটা জীবন্ত, এতোটা প্রানবন্ত কিংবা এতোটা মায়াকড়া লাগতে পারে, তিনি ভাবতেই পারেননি। তিনি সামান্য কাঁপছেন। ঠিক মতো সিগারেট খেতে পারছেননা। আকাশটা আজ বেশ পরিষ্কার। ঠাণ্ডা বাতাসে তার চুল গুলো উড়ছে। মাঝে মাঝে তিনি হতাশ ভঙ্গিতে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছেন। তাকে দেখে মনেই হচ্ছে না যে সে কিছুক্ষণ আগে তার স্ত্রীকে বিষ খাওয়ায় হত্যা করেছেন। পরিকল্পিত হত্যা না। ঝোঁকের বশে হত্যা করেছেন। এখন বেশ অবাক হচ্ছেন। মাথার মধ্যে বারবার একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে, “এ আমি কি করলাম? কি করলাম?” জামিল হোসেনের বাবা তাকে ছোটোবেলায় বলেছিলেন, “বাবা, রাগ পুষে রেখে ঝোঁকের বশে কিছু করিস না। এটা খুব খারাপ। দেখবি একসময় হয়তো নিজেরই ক্ষতি করে বসে আছিস। তখন কোথাও যাওয়ার পথ থাকবেনা।” তার বাবার কথা আজ সত্য হয়েছে। তিনি ঝোঁকের বশে তার স্ত্রীকে হত্যা করেছেন। হারিয়েছেন পৃথিবীর সবথেকে প্রিয় মানুষটিকে। যাকে তিনি অনেক ভালবাসতেন। তার স্ত্রীও তাকে অনেক ভালোবাসতো। হয়তো এখনো বাসে।

এইতো আজ সন্ধ্যায়ও সব ঠিক ছিল। তিনি বাসায় এসে নাবিলাকে বলেছেন, ‘শোনো তুমি এখন নীল শাড়িটা পড়বে। আমরা একটু পরে ছাদে গিয়ে রাতের খাবার খাবো, কেমন?’

‘হটাৎ এতো প্রেম? কি ঘটনা বলতো?’
‘হটাৎ প্রেম পেলে কোথায়? আমি কি তোমাকে ভালোবাসি না?’
‘হ্যাঁ বাসো। কিন্তু আজ কেন জানি তোমাকে অন্যরকম লাগছে, তাই বললাম, আচ্ছা তুমি ওয়েট করো, আমি শাড়িটা পরে আসি। তুমি সেই ফাঁকে একটু ফ্রেশ হয়ে নাও।’
জামিল হোসেন তখন সোফায় বসতে বসতে বললেন, ‘হু, এক কাজ করি, তুমি শাড়ি পরে আসো। অনেক গরম লাগছে, আমি তোমার জন্য শরবত বানাই।’
নাবিলা বেশ অবিশ্বাস চোখে জামিল হোসেনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘আচ্ছা, যা মন চায় করো। আমি আসছি।’
জামিল হোসেন শরবত বানাতে গিয়েই যত সর্বনাশ করেছেন। বিষ কেনার সময়ও মনস্থির করেননি যে তিনি শরবতে বিষ মেশাবেন। কি মনে করে মেশালেন।

আজকের তারিখটা হচ্ছে ১৫ই ডিসেম্বর, ২০১৩। আজ নাবিলার মৃত্যুদিন। জামিল হোসেন হাত পা গুটিয়ে নাবিলার পাশে বসে সিগারেট খাচ্ছেন। এটা ১৫ নম্বর সিগারেট। এক সাথে এতো গুলো সিগারেট তিনি কখনো খাননি। তিনি সামান্য দুশ্চিন্তাবোধ করছেন। কি করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। একবার ভেবেছেন লাশটা বস্তায় ভরে নদীতে ফেলে দিয়ে আসবেন। আবার ভেবেছেন, কি দরকার, এখান থেকে পালিয়ে গেলেই হয়। সব থেকে ভালো হয়, আরেক গ্লাস শরবত বানিয়ে তাতে বিষ গুলিয়ে খেয়ে ফেলেন। পরেরদিন বড় বড় পত্রিকায় তাদের নাম আসবে, হেডলাইন হবে; ‘স্বামী স্ত্রী অতিরিক্ত গরম সহ্য করতে না পেরে বিষযুক্ত শরবত খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন।’ মন্দ হয়না।
নাবিলা অনেক ভালো একটা মেয়ে ছিল। তিনি শুধু শুধু তাকে সন্দেহ করেছেন। শুধু সন্দেহ করেননি, খুব খারাপ ভাবেই সন্দেহ করেছেন। যদিও সব সন্দেহই ভুল ছিল। তবুও কেন জানি তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না কিছু। শুধু ভেবেছেন, তার স্ত্রী নাবিলা অন্য পুরুষের সাথেও শারীরিক সম্পর্ক করেছে। এবং প্রতিদিন করে। ভুল হয়েছে। অনেক বড় ভুল হয়েছে।

জামিল হোসেন তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে। আজকের চাঁদটা অনেক সুন্দর। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন চাঁদের বুড়ি তার নাতনীকে কোলের মধ্যে নিয়ে বসে আছে। অদ্ভুত এক ঠাণ্ডা বাতাসে তার শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা চাঁদের বুড়ি কি তাকে ক্ষমা করবে তার অপকর্মের জন্য। পারবেনা বোধহয়।

জামিল হোসেন ১৮ নম্বর সিগারেট ধরিয়েছেন। নাবিলা এখনো তাকিয়ে আছে চাঁদের দিকে। যেন প্রকৃতিকে সে বলছে, আমাকে তোমার মাঝে টেনে নাও। আমি তোমার মাঝে হারিয়ে যেতে চাই।

Comments

Popular posts from this blog

Kabhi Haan Kabhi Naa

চিঠি

Awe! (2018)