Veer Zaara
Spoiler Alert
শুরুতেই
ইয়াশ চোপড়ার ম্যাজিকাল কণ্ঠে কবিতা। কবিতা শেষ হওয়া মুহুর্তেই সনু নিগম আর
লতা গেয়ে ওঠে আমার প্রিয় সব থেকে ম্যাজিকাল গানটা, “কিউ হাওয়া আজ ইউ গা রা
হি হে”। সনুর কণ্ঠের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে স্ক্রিনে চলে আসে আমার প্রিয়
সুপারস্টার শাহরুখ খান। সাদা জামা পড়ে সাদা নৌকায় ভেসে প্রকৃতির সাথে মিশে
যাওয়ার দৃশ্য আমাকে আজও অনুপ্রেরণা দেয় প্রকৃতির সাথে এভাবে একাত্বতা ঘোষনা
করার। মুভির শুরুতেই এই গান মনের মধ্যে একটা প্রশান্তি দেয়। মুভি দেখার
আগ্রহ কয়েকগুন বাড়িয়ে দেয়।
এই
গান শেষ হওয়া মুহুর্তেই দেখা যায়, বৃদ্ধ বীর প্রতাপ সিং স্বপ্নে জারা
হায়াত খানকে গুলি খেতে দেখে ধরফর করে ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসে। শাহরুখ খানের এই
বৃদ্ধ চরিত্র তার ক্যারিয়ারে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবে আজীবন। ২২ বছর ধরে
বীর প্রতাপ সিং নিজেকে জেলে বন্দী করে রেখেছে। এই ২২ বছরে কারো সাথে একটা
কথা পর্যন্ত বলেনি। শুধুমাত্র জারার সন্মান রক্ষার্থে। কেউ তার গল্প
জানেনা। হঠাৎ একদিন সামিয়া সিদ্দিকি নামের একজন হিউমান রাইটস লয়ার এগিয়ে
এলো এই বীর প্রতাপ সিং এর গল্প জানার জন্য। ২২ বছর ধরে যেই মানুষটাকে সবাই
কয়েদী নম্বর ৭৮৬ বলে আসছে, সামিয়া সিদ্দিকি সেদিন তাকে বীর প্রতাপ সিং নামে
ডেকে বসলো। বীরের তার নিজের নাম শুনে মন নরম হয়ে গেলো। তার মনে হলো
আরেকটাবার বেঁচে থাকা যায়। আরেকটাবার আশায় বুক বাঁধা যায়। বীর এই অচেনা
অজানা মেয়েটাকে তার গল্প বলা শুরু করলো, শুধুমাত্র মেয়েটা তাকে সন্মান
দেখিয়েছে বলে। ২২ বছর ধরে তাকে তার নামে কেউ ডাকেনি। ভালোবাসার জন্য
হাসিমুখে সেটা সে মেনেও নিয়েছে। সে কিভাবে বেঁচে আছে শুধুমাত্র জারার
একপায়ের নূপুর আর জারার মায়ের দেওয়া মাদুলি নিয়ে, সেই গল্প সে বলতে শুরু
করলো।
এরপরে
আসে আরেকটা ম্যাজিকাল গান, উদিত নারায়ণ আর লতা মঙ্গেশকরের স্বর্গীয় কণ্ঠে
“এয়সা দেশ হে মেরা”। এই গানের মধ্যে দিয়ে বন্ধুত্ব হয়ে যায় বীর আর জারার।
গান শেষে দেখা যায়, জারা তার নিজের দেশ পাকিস্তান থেকে ভারতে আসে তার দাদীর
শেষ ইচ্ছে পূরন করতে যেটা সে বীরের সাহায্যে খুব সহজেই পূরন করতে পারে।
জারা বীরকে বলে, “আমি আপনাকে কিভাবে ধন্যবাদ দিতে পারি, বলেন।” বীর বলে,
“আমি সোজাসাপ্টা কথা বলতে পছন্দ করি। আপনি ভেবে দেখুন। পরে কিন্তু
পস্তাবেন।” জারা চোখে মুখে হাসি নিয়ে বলে, “হ্যাঁ, আপনি যা চাইবেন তাই
দিবো। আপনি বলেন।” এর পরে বীর বলে, “আমি আপনার জীবন থেকে একটা দিন চাই।
আমার জীবনের একদিন আপনার জীবনের সাথে শেয়ার করতে চাই।” জারা এই কথা শুনে
চোখে মুখে সংশয় নিয়ে তাকিয়ে থাকে বীরের দিকে। বীর বলে, “বলেছিলাম না, আপনি
পস্তাবেন?” ঠিক এই মুহুর্তে যদি জারা বলতো, না সেটা সম্ভব না। গল্প শেষ হয়ে
যেতো। মজার ব্যাপার হচ্ছে। মূল গল্প এখানেও শুরু হয়নি।
বীরের
পৃথিবী দেখে আসার পরে যখন জারা তার নিজের দেশে চলে যেতে যায় তখন বীরের
পরিচয় হয় জারার ফিয়ান্সের সাথে। গল্প শুরু হয় সেখানে। জারা ভুলেই গিয়েছিল
বীরকে বলতে যে তার ফিয়ান্সে আছে। ঠিক যেমন রুবা ভুলে গিয়েছিলো আমাকে বলতে
তার ফিয়ান্সে আছে। যাই হোক, এইখানে দুইজনে আলাদা হয়ে যায়। পিছনে বেজে ওঠে
সনু নিগম আর লতা মঙ্গেশকরের আরেকটা বিখ্যাত ম্যাজিকাল গান, “দো পাল রুখা”।
এমন কোনো মানুষ নেই এই গানে মাতেনি। অদ্ভুত এই গানের সুরে নিজেকে হারায়নি।
প্রেমে ব্যর্থ হওয়া এমন কোনো প্রেমিক প্রেমিকা নেই যে এই গান তার প্রিয়
গানের তালিকায় রাখেনি। এই গানের প্রিয় দৃশ্য হচ্ছে জারা শেষ বারের মতো,
ট্রেনে ওঠার আগে বীরের দিকে তাকিয়ে সালাম দেয়। আর ২২ বছর পরে বীর জেলে বসে
সেই ঘটনা স্মরণ করে সালামের উত্তর দেয়।
বীর
আর জারার আবার দেখা হয়। তখন জারা তার পরিবারের সবার সামনে এমনকি তার
ফিয়ান্সের সামনে বীরকে দেখে তার কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। এই দৃশ্য দেখে
আবেগে ভেসেছিলাম। বীর নিতে এসেছিলো জারাকে কিন্তু নিয়ে যেতে পারেনি। জারার
মা এসে বীরকে বলেছিলো, "আমি জানতাম, জারা আমার মেয়ে। কিন্তু আজ জানলাম।
জারা আমার কেউ না। জারা তোমার। একজন মা হয়ে তোমার কাছে অনুরোধ করছি, আমার
মেয়েকে ফিরেয়ে দাও।" বীর বললো, "আপনার মেয়ে আপনার থাকবে। আপনার কি ধারণা?
আমি আপনার অনুমতি না নিয়ে তাকে নিয়ে যেতাম? কখনোই না। জারা, আপনাদের কথা
মতো বিয়ে করবে। আমি ওকে বুঝিয়ে বলবো।" জারার মা বলে, "তোমার দেশের সব
ছেলেরা কি তোমার মত?" বীর বলে, "আমি জানিনা, কিন্তু আমার দেশের সব মায়েরা
আপনার মত।"
জারার
বিয়ে হবার সময় জানতে পারে বীর যেই বাসে করে ভারত ফিরে যাচ্ছিলো সেই বাস
এক্সিডেন্টে খাঁদে পড়ে যায়। কেউ বাচেনি। বীরের মৃত্যুর খবর শুনে জারা বিয়ে
ভেঙ্গে দেয়। চলে যায় ভারতে, বীরের সাথে একদিন কাটানো সেই গ্রামে। অন্যদিকে
বীর জারার সন্মান রক্ষা করার জন্য জারার ফিয়ান্সের কথা অনুযায়ী বিনা দোষে
পাকিস্তানের লাহোরের জেলে ঢুকে যায়। সে জানতেও পারে না, জারা ততোক্ষণে
বীরের গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। একটা ভুলে ২২ টা বছর জারা কাটিয়ে দেয় বীরের
গ্রামের বাড়িতে আর বীর কাটিয়ে দেয় জেলে। বীরের লয়ার সামিয়া সিদ্দিকি বীরের
গ্রামের বাড়ী আসে তার আসল পরিচয় জানতে। কিন্তু বাড়িতে পা রেখে যখন সে দেখা
পায় জারার তখন সামিয়া সিদ্দিকির সাথে আমিও কেঁদেছিলাম। চোখে ভেঙ্গে পানি
পড়ছিলো। ছোটবেলায় যখন প্রথম দেখেছিলাম এই সিনেমা, তখনো কান্না আটকে রাখতে
পারিনি। আজ আবার দেখলাম। আজও ধরে রাখতে পারিনি নিজেকে।
সর্বশেষে
আসে সেই বিখ্যাত দৃশ্য, বিখ্যাত গান। লতা মঙ্গেশকর আর রুপ কুমারের কণ্ঠে
“তেরে লিয়ে” গানটা। দীর্ঘ ২২ টা বছর ধরে জারাকে আর একটি বার দেখার জন্য
অপেক্ষা করে থাকা বীর আর দীর্ঘ ২২ টা বছর ধরে বীরের মৃত্যু মেনে নেওয়া জারা
দুইজনে সামনা সামনি আসে। অন্যের খবর জানিনা, প্রথমবার এবং যতবার এই মুভি
দেখতে দেখতে শেষে এই গান এসেছে, আমি কেঁদেছি। আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। এই
গানে প্রিয় দৃশ্য, বীরের কাছে থাকা জারার এক পায়ের নূপুর, এত বছর পড়ে এসে
সে জারাকে পড়িয়ে দেয়।
যে
দৃশ্যের কথা বললেই নয়। শাহরুখের ক্যারিয়ারের আইকনিক দৃশ্য। কোর্টে দাঁড়িয়ে
পকেট থেকে কাগজ বের করে বিনয়ী ভঙ্গিতে বলতে শুরু করে, “আমি, কয়েদী নম্বর
৭৮৬...”।
এই
মুভির প্রতিটা গান আমাকে মুগ্ধ করে। বলিউড ইন্ডাস্ট্রি আর কোনোদিন এমন
ম্যাজিকাল গান কিংবা এমন ম্যাজিকাল মুভি উপহার দিতে পারবে কিনা সন্দেহ।
কারন, দর্শকের চাহিদা পরিবর্তন হচ্ছে, আরো হবে।
এই
মুভিতে কাজ করেছে বলিউডের সব থেকে প্রতিভাবান ব্যাক্তিরা। নাম বলা শুরু
করলে শেষ হবে না। শাহরুখ খান, রানী মুখার্জী, প্রীতি জিনতা, অমিতাভ বচ্চন,
হেমা মালিনি, বোমান ইরানি, কিরণ খের, অনুপম খের, মনোজ বাজপায়ী। লিখেছে
আদিতা চোপড়া, পরিচালনা করেছে ইয়াস চোপড়া। গান নিয়ে কাজ করেছে লতা মঙ্গেশকর,
সনু নিগম, উদিত নারায়ণ। প্রতিটা গান লিখেছে জাভেদ আখতার, প্রতিটা গান
কম্পোজ করেছে মদন মোহন। প্রতিভার ছড়াছড়ি।
বহু
বছর পড়ে, বহুবার দেখার পড়ে আজ হঠাৎ খুব লিখতে ইচ্ছে হচ্ছিলো মুভিটা নিয়ে।
লিখে ফেললাম। আরো লিখতে ইচ্ছে করছে। এই মুভি নিয়ে ছোটবেলায় কত স্মৃতি জড়িয়ে
আছে। জিন্সের জ্যাকেট কেনার জন্য পাগলামি করেছিলাম এই মুভি দেখে। প্রেমের
গভীরতা বুঝেছি এই মুভি দেখে। এখন অবাক হই, সেই সময় এইসব ম্যাজিকাল মুভি আর
এইসব ম্যাজিকাল গান শুনে বড় হয়েছি। ধন্যবাদ শাহরুখ, এইসব মুভি দিয়ে মাতিয়ে
রাখার জন্য। এই ম্যাজিকাল মুভি দেখে, এই ম্যাজিকাল গান শুনে মেতে থেকেছি ১৬
বছর। বাকি জীবনও মেতে থাকবো। বৃদ্ধ বয়সে চোখ বন্ধ করে এই মুভির গান শুনতে
শুনতে আমার ছেলেবেলা স্মরণ করবো, আশা করি। তখনো এই ভালো লাগা বিন্দুমাত্র
কমবে না বলে বলেই আমার বিশ্বাস।
Comments
Post a Comment