Skip to main content

কিছু কুয়াশা আর একটা লাল ক্যাকটাস



নিচে দাড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলাম। একটা টেক্সট আসলো। "কোথায় আপনি? কি করেন?" আয়েশ করে টান দিতে দিতে লিখলাম, "সিগারেট খাই। তোমার বাড়ির নিচে।" উত্তর আসলো, "আমারো খেতে ইচ্ছা করছে। পচা পচা গান ছাড়ছে। বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাবস্থা করেন।" আমি লিখলাম, "টেক্সট দেওয়া বন্ধ করো। যারা তোমার গায়ে হলুদ লাগাচ্ছে, তাদের অন্তত প্যারা দেওয়া বন্ধ করো।"


আমি নিশ্চিত, রুবা আমার এই টেক্সট পরে খিলখিল করে হাসছে। কেমন একটা বেমানান ব্যাপার! সে হলুদ শাড়ি পরে সবার মধ্যমণি হয়ে বসে আছে। সবাই এক এক করে এসে তার গালে হলুদ লাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আর সে আমার টেক্সট পরে খিলখিল করে হাসছে। রাত বাজে প্রায় ১১ টা। হলুদ অনুষ্ঠান প্রায় শেষ। এখন মনে হয় রুবার হাতে মেহেদী লাগানো হবে। কালকের জন্য। কাল ওর বিয়ে। আমি সিগারেটের শেষ টান দিতে দিতে ভাবলাম, লেখকদের জন্য কি প্রেমে পড়া খুব জরুরী?


স্টেজ ফাঁকা। রাত বেশ হয়েছে। একটা মেয়ে রুবার হাতে মেহেদী লাগিয়ে দিচ্ছে। আমি স্টেজের সামনে গিয়ে বসলাম। রুবা আমাকে দেখে একটা হাসি দিলো। এই হাসির কোনো অর্থ নেই। সেটা জেনেও আমি সেই হাসির অর্থ খুঁজে বের করার ব্যার্থ চেষ্টা করতে লাগলাম। কেন আমাকে এই হাসি দিলো? রুবা কি জানেনা, তার প্রতিটা হাসি অতি মূল্যবান। হাসিগুলো তার ভালোবাসার মানুষের জন্য রেখে দেওয়া উচিত। রুবার গালে কোনো হলুদ নেই। সে যা বলেছে সেটাই হয়েছে। রুবা বলেছিলো, কেউ যেন তার গালে হলুদ না মাখায়। শুধুমাত্র হাতে দেওয়া যাবে। আর কোথাও না। এক সুযোগে তার গাল স্পর্শ করাটা মিস হয়ে গেলো। হঠাৎ মনে পড়লো, কি ভাবছি এসব? উঠে গিয়ে ছাঁদের কোনায় গিয়ে দাঁড়ালাম।

কুয়াশা আমাকে ডাকছে। হাত বাড়ালাম। মনে হলো খুব পরিচিত কোনো স্পর্শ। যে স্পর্শে ভালো লাগা নেই, ভালোবাসা নেই, অভিমান আছে। খুব খেয়াল করলাম, কুয়াশা গুলো আমার হাতে ভিজছে না, গলছে না, কাঁদছে না অভিমান করে, স্পর্শ করে চলে যাচ্ছে। খুব ক্ষুধা লাগছে। কিন্তু খেতে ইচ্ছা করছে না। দূরে দাড়িয়ে রুবাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। একটা গল্পের অপমৃত্যু দেখতে ইচ্ছে করছে। মৃত্যু খুব স্বাভাবিক বিষয়। এতে কাঁদতে নেইরুবার নামার সময় হয়ে গেছে। আমি আগেই নেমে গেলাম। না খেয়ে থাকি, কিন্তু ঘুমানো দরকার। কাল ওর কান্না দেখতে হবে। ও একবার বলেছিল, আমার বিয়ের দিন, আমি কাঁদবো না। সবাই কাঁদে, কিন্তু আমি সেদিন হাসিমুখে বিদায় নেবো। আমি বলেছিলাম, কান্না বাঙ্গালী মেয়েদের শরীরের রক্তে মিশে আছে। বিয়ের দিন তো অবশ্যই। তোমাকে কাঁদতেই হবে, বাজি ধরে বলছি, তুমি সেদিন কাঁদবে, আর আমি সেটা দূর থেকে দাড়িয়ে দেখবো।


রুবাকে দেখতে ভালো লাগছে না। ইদানিং বাংলাদেশের কি এক অদ্ভুত ট্রেন্ডিং চালু হয়েছে, সুন্দর সুন্দর মেয়েদের পার্লার নামক একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে অসুন্দর বানিয়ে নিয়ে আসা হয়। মেয়েটা যদি শুধু একটা লাল শাড়ি পড়তো, ঠোটে লাল লিপিস্টিক, কপালে একটা টিপ থাকতে পারে। ব্যাস, তাকিয়ে থেকে হারিয়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু কি জানি, মেয়েরা সাজতে পছন্দ করে। করুক। কষ্ট পেয়ে কাঁদার মত বাঙ্গালী মেয়েদের সাজগোজ করা রক্তে মিশে আছে। থাকুক। একদিনই তো। বাসর রাতের পরে ভোর বেলা ঠিকই সেই লাল শাড়ি পরে ফ্রেশ মুখে সামনে আসতে হবে।


আমি আবার আবোল তাবোল ভাবতে শুরু করছি। ছাঁদের কোনার টেবিলে পানির জগ নেই। বেজ্জইতি ব্যাপার। কনে পক্ষের লোক যেহেতু, ইজ্জত রক্ষা করা ফরয। এর মধ্যে একজন আমাকে ডাক দিয়ে বলল, "এই ওয়েটার, এখানে বোরহানি দাও।" আমি হাসিমুখে বললাম, "জ্বি আচ্ছা স্যার, এখনি দিচ্ছি।" এক হাতে পানির জগ আর আরেক হাতে বোরহানির জগ নিয়ে এগিয়ে গেলাম রুবার শ্বশুরবাড়ির লোকদের খাওয়াতে। এক ফাঁকে রুবার দিকে তাকালাম। বর কনেকে একসাথে পেয়ে সবাই ছবি তুলছে। রুবা বিরক্ত নিয়ে হাসিহাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে। তার ছবি তোলা একদমই পছন্দ না। আমি সেটা জানি একবার ওকে বলেছিলাম, "এই যে তোমার ছবি তোলা পছন্দ না, বিয়ের সময় কি করবা?" রুবা বলেছিল, "সে দেখা যাবে।" রুবা এত ভিড়ের মধ্যে আমাকে ঠিকই খুঁজে বের করলো। চোয়াল শক্ত করে হাসিহাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি হেসে দিলাম। হাসি সেকেন্ডের মধ্যে নাই হয়ে গেলো। ইচ্ছা করলো, রুবাকে এই পরিস্থিতির মধ্যে থেকে বের করে নিয়ে আসতে। কিন্তু সেটা সম্ভব না। এই পরিস্থিতির স্বীকার ও একা। আমি সেখানে নেই।


রুবা কাঁদছে। আমি বাজিতে জিতে গেছি। রুবার কান্না দেখতে পারছি। রুবা এক এক করে সবার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করছে। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করাটা আমার ঠিক পছন্দ না। পায়ে হাত দেওয়া মানে, তার সামনে মাথা নত করা। আমি শুধুমাত্র আমার সৃষ্টিকর্তার সামনে মাথা নত করবো। অন্য কারো সামনে না। আচ্ছা, আমি আসলে কি? রুবা আমার খুব সামনে দাড়িয়ে কাঁদছে আর আমি হিসাব করছি পায়ে হাত দিয়ে সালাম করা উচিত কিংবা উচিত না? সবার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পরে আবার সেই খুঁজতে থাকা চোখ। আমি হাত দিয়ে ইশারা করলাম, আমি এখানে। রুবার চোখে পানি, কিন্তু কাজল লেপ্টে যায়নি। মাথাটা হালকা নেড়ে ইশারায় বললো, "আসি?" আমিও ইশারায় বললাম, "হুম, আসো।"

রুবার বিয়ের গাড়ি ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। ফুল ভালোবাসার প্রতীক। দুইটা মানুষ সারাজীবন একসাথে থাকবে। তাদের যাত্রা শুরু হবে এই গাড়িতে। সেই গাড়ি ভালোবাসার প্রতীকী দিয়ে সাজানো হয়েছে। বাড়ির সামনে বিশাল লাইন। সবাই রুবাকে বিদায় দেওয়ার জন্য দাড়িয়ে আছে। রুবা একজন যুবা পুরুষের পিছু পিছু হেটে যাচ্ছে। যে তাকে সারাজীবন অন্ধকার জগৎ থেকে আগলে রাখবে। আচ্ছা রুবা এখন কি ভাবছে? সে কি এখনো কাঁদছে? আমি জানিনা। দূরে দাড়িয়ে আছি। দেখতে পাচ্ছি না। রুবা ছোট ছোট পা ফেলে হেটে যাচ্ছে। সবাই তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছে। গাড়ির খুব কাছে গিয়ে রুবা বলল, মামী, টবটা কই? টবটা দেন। মামী বলল, এখন টব দিয়ে কি করবি? তুই গাড়িতে ওঠ। আমি ঐটা অন্য গাড়িতে পাঠায় দিবো। রুবা বলল, আপনাকে দিতে বলছি, দেন। কি করব সেটা আমার বিষয়। অবাক হয়ে দেখলাম, রুবা তার বিয়ের গাড়ির সামনে দাড়িয়ে আমার দেওয়া লাল রঙের ক্যাকটাসটার জন্য তার মামীর সাথে তর্ক করছে। কেউ কিছু বুঝছে না। আমিও কিছু বুঝছি না। রুবার মামী আর কোনো কথা না বাড়িয়ে লাল ক্যাকটাসের ছোট টবটা রুবার হাতে এনে দিলো। রুবা টবটা হাতে নিয়ে গাড়িতে উঠলো। গাড়িতে বসে টবটা তার কোলে রাখলো। গাড়ি ছেড়ে দিলো। রুবা চলে যাচ্ছে। যাওয়ার আগে আমাকে কিছুটা সময়ের জন্য নিথর করে দিয়ে গেলো।

রুবা চলে গেলো। পাখি চলে গেলে পাখির পালক রেখে যায়। রুবা রেখে গেলো অসমাপ্ত গল্প। যে গল্পের মৃত্যু হবে। অপমৃত্যু, কিন্তু স্বাভাবিক। আমি আবার নতুন করে কারো প্রেমে পড়বো। নতুন কোনো গল্প লিখবো। সেসব গল্প হয়তো সমাপ্ত হবে। কিন্তু রুবার গল্প অসমাপ্ত রয়ে যাবে। সবাই পড়বে কিন্তু কেউ ভাববে না। শুধু লেখক ভাববে। রুবার গল্পে ভালোবাসা ছিলো না, অভিমান ছিলো না। ছিলো কান্না, কুয়াশার মত স্পর্শ করে এড়িয়ে যাওয়া। ভেবে যাবে কিন্তু আর লিখতে পারবে না।

Comments

Popular posts from this blog

রহস্যময় ভালবাসা

ভুমিকা ভুমিকা সাধারনত উপন্যাসের হয় কিংবা রচনা জাতীয় কোনো লেখায় হয়। একটা গল্পের জন্য ভুমিকা লেখা হাস্যকর। তবুও লিখলাম। এই গল্পের সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই। এটা শুধুই কল্পনা দিয়ে লেখা। তবে নাম গুলোর অস্থিত্ত্ব আছে। ভুতের গল্প লিখতে চেয়েছিলাম। যে গল্প মাথায় ছিল সেটা তেমন ভয়ঙ্কর বলে আমার মনে হলো না। কিংবা আমি হয়ত ভয়ঙ্কর কিছু লিখতে পারতাম না। তাই লিখলাম না। আশা করি এই গল্পটা পড়ে খুব বেশি বিরক্ত হবেন না। যদি আপনার ভালো লাগে তাহলে ধন্যবাদ। ভালো না লাগলেও ধন্যবাদ।  ইশতিয়াক আহমেদ চৌধুরী টুটপাড়া ঘোষের ভিটা, খুলনা ২০.০৯.২০১২  উৎসর্গ  একটা মানুষকে কি দুইবার উৎসর্গ করা যায়? এইটা সেই মানুষটার জন্য, যার কাছেই শুধুমাত্র আমি একজন লেখক। যার কাছে আমার ভালো কাজেরও মূল্য আছে, খারাপ কাজেরও মূল্য আছে। আমার অদ্ভুত আচরণে সে বিরক্ত হয়, আসলে সে মুগ্ধ হয় বলে আমার বিশ্বাস।  মানুষটা আমাকে অনেক ভালোবাসে, এত কেন ভালোবাসে, কিভাবে ভালোবাসে, আমি কিছুই জানিনা। আমার প্রিয় হলুদিয়া পাখি একটা মেয়ে কতটা সুন্দর হলে একটা ছেলে মেয়েটার দিকে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে? একটা মেয়ে ঠিক কতটা সুন্দর হলে

Veer Zaara

  Spoiler Alert শুরুতেই ইয়াশ চোপড়ার ম্যাজিকাল কণ্ঠে কবিতা। কবিতা শেষ হওয়া মুহুর্তেই সনু নিগম আর লতা গেয়ে ওঠে আমার প্রিয় সব থেকে ম্যাজিকাল গানটা, “কিউ হাওয়া আজ ইউ গা রা হি হে”। সনুর কণ্ঠের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে স্ক্রিনে চলে আসে আমার প্রিয় সুপারস্টার শাহরুখ খান। সাদা জামা পড়ে সাদা নৌকায় ভেসে প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়ার দৃশ্য আমাকে আজও অনুপ্রেরণা দেয় প্রকৃতির সাথে এভাবে একাত্বতা ঘোষনা করার। মুভির শুরুতেই এই গান মনের মধ্যে একটা প্রশান্তি দেয়। মুভি দেখার আগ্রহ কয়েকগুন বাড়িয়ে দেয়।   এই গান শেষ হওয়া মুহুর্তেই দেখা যায়, বৃদ্ধ বীর প্রতাপ সিং স্বপ্নে জারা হায়াত খানকে গুলি খেতে দেখে ধরফর করে ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসে। শাহরুখ খানের এই বৃদ্ধ চরিত্র তার ক্যারিয়ারে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবে আজীবন। ২২ বছর ধরে বীর প্রতাপ সিং নিজেকে জেলে বন্দী করে রেখেছে। এই ২২ বছরে কারো সাথে একটা কথা পর্যন্ত বলেনি। শুধুমাত্র জারার সন্মান রক্ষার্থে। কেউ তার গল্প জানেনা। হঠাৎ একদিন সামিয়া সিদ্দিকি নামের একজন হিউমান রাইটস লয়ার এগিয়ে এলো এই বীর প্রতাপ সিং এর গল্প জানার জন্য। ২২ বছর ধরে যেই মানুষটাকে সবাই কয়েদী নম্বর ৭৮৬ ব

Anveshanam (2020)

No Spoiler মুভির নাম Anveshanam , এটি একটি মালায়ালাম মুভি। মুভিতে একটা দৃশ্য দেখে বহু বছর পরে বুক কেঁপে উঠেছিলো। অত্যন্ত চমৎকার একটা মুভি। সিরিয়াল কিলার রিলেটেড থ্রিলার মুভি দেখতে দেখতে বিরক্ত ধরে গেলে চট করে এই হাসপাতাল পরিবেশে বানানো থ্রিলার মুভিটি দেখে ফেলুন। থ্রিলার মুভির নানান ধরণ আছে। আমার কাছে এই ধরণের থ্রিলার বেশি ভালো লাগে। সব থেকে বেশি ভালো লেগেছে এর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। দূর্দান্ত লেগেছে। প্লট অনুযায়ী পারফেক্ট মিউজিক।   আমি প্রথমে ট্রেইলার দেখেছিলাম। ট্রেইলার অর্ধেক দেখেই আমার আগ্রহ জাগে এবং সাথে সাথে ডাউনলোড দিয়ে দেখতে বসে গেছি। আপনারা চাইলে ট্রেইলারটা দেখে আসতে পারেন। আগ্রহ জাগানোর জন্য প্লট সম্পর্কে একটু বলি। হাসপাতালে একটা বাচ্চা ভর্তি হয়েছে। বলা হচ্ছে বাচ্চাটা এক্সিডেন্ট করেছে। পুলিশ এসে ইনভেস্টিগেশন শুরু করলে দেখা যায় বাচ্চার বাবা মা থেকে শুরু করে প্রত্যেকে প্রত্যেকের জায়গা থেকে মিথ্যা কথা বলছে। কিছু একটা লুকাচ্ছে। কি লুকাচ্ছে? সেটাই রহস্য। এই রহস্যে জানতেই মুভিটা দেখতে হবে।   এই মুভির কোনো রিভিউ আমার চোখে পড়েনি। কিন্তু এই মুভি নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা করা উচি